সাভারের হেমায়েতপুর-সিঙ্গাইর সড়কের তেঁতুলঝোড়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশ দিয়ে বাঁ দিকের রাস্তায় ১০০ গজ সামনে এগোলেই দেখা যায় হলমার্ক গ্রুপের বিভিন্ন পরিত্যক্ত শিল্প-কারখানা। ১৩৭ একর জায়গাজুড়ে নির্মিত হলমার্ক গ্রুপের বিশাল এই শিল্পপার্কে ৪৩টি কারখানায় প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন।
ছিল মসজিদ, বিশ্রামাগার, ফায়ার সার্ভিস, আনসার ক্যাম্পসহ উন্নত জাতের গাভি পালনের শেড। সব মিলিয়ে পুরো এলাকাটি জমজমাট ছিল।
মাঝেমধ্যে শ্রমিকদের জন্য আয়োজন করা হতো পিকনিক ও বিনোদনের, যা এখন কেবলই স্মৃতি। পুরো এলাকা ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হেমায়েতপুর-সিঙ্গাইর এলাকার শহীদ রফিক সেতুর বাঁ পাশে বেশ কয়েকটি নির্মীয়মাণ ভবন পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। এর কোনোটির একতলা থেকে চারতলা পর্যন্ত ছাদ ঢালাই হয়েছে। দুটি ভবনের শুধু পিলার পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে।
ভবনগুলোর পশ্চিম পাশ দিয়েই বয়ে গেছে ধলেশ্বরী নদী। সব কটি ভবনেই শেওলা ধরেছে। ভবনগুলোতে মাদকসেবী ও ভবঘুরেদের দেখা যায়। এখানকার কারখানাগুলোতে কোনো মেশিনপত্র নেই।
কোথাও কোথাও মাটির সঙ্গে মিশে গেছে ভবন। অনেক ভবন ভেঙে রিকশা ও গাড়ির গ্যারেজসহ ভাঙ্গারির দোকান ভাড়া দেওয়া হয়েছে। তবে সেখানে দায়িত্বরত নিরাপত্তা কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে কোনো কিছু জানা সম্ভব হয়নি। আগে হলমার্ক শিল্পপার্কের মূল ফটক এবং চতুর্দিকে নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকলেও বর্তমানে সব কিছু উন্মুক্ত। ভেতরে গড়ে উঠেছে কয়েকটি দোকানও।
বেশ কয়েকটি ভবনের মধ্যে সাধারণ মানুষ বসবাস করলেও বেশির ভাগ ভবনই ব্যবহার অনুপযোগী। বেহাত হওয়ার পথে হলমার্কের অনেক জমিজমা। বেশির ভাগ কারখানার যন্ত্রপাতি চুরি করে বিক্রি করার পাশাপাশি রাতের আঁধারে প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় কারখানার লোহার শেডগুলো কেটে কেজি দরে বিক্রি করা হয়েছে। প্রথমে বাধা দিতে গিয়ে হলমার্কের একজন নিরাপত্তা কর্মী খুন হলে পরে ভয়ে কেউ আর এ বিষয়ে কথা বলত না।
হলমার্কের কয়েকজন সাবেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দীর্ঘদিন এই গ্রুপে চাকরি করেছি। তাই মাঝেমধ্যে কারখানা এলাকায় যাই। তবে সেখানে এখন আর কিছুই নেই। সব বিক্রি করে দিয়েছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। জমি দখলের পর এখন চলছে বিক্রির অপচেষ্টা। কারখানা এলাকার একটি ভবনের মধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে আমেনা মাখনুস মাদরাসা ও এতিমখানা। তবে মাদরাসার শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও কাউকে পাওয়া যায়নি।
এ ছাড়া কয়েকটি ভবনে স্থানীয় লোকজন মালিক হিসেবে নিজেদের নামফলকও টানিয়েছেন। যদিও হলমার্কের মালিকপক্ষের অবর্তমানে ওই সব জমি নিয়ে আদালতে বিচার চলছে। দক্ষিণে একেএইচ কারখানাসংলগ্ন কারখানার শেড ভেঙে তৈরি করা হয়েছে রাস্তা। পাশেই অবশিষ্ট একটি কারখানার শেডে অটোরিকশার গ্যারেজ করেছেন মোশারফ নামের এক ব্যক্তি। এর সঙ্গে লাগোয়া একটি মার্কেটের কয়েকটি দোকান ভাড়া দিয়েছে হলমার্ক কর্তৃপক্ষ।
এ ছাড়া প্রকল্পের শুরুতে গেট দিয়ে ঢুকতেই নির্মিত একটি বহুতল ভবন ভাড়া দেওয়া হয়েছে আনসারী ডোর কারখানাকে। প্রকল্পের শেষপ্রান্তে অবস্থিত হলমার্কের লেভেল ফ্যাক্টরিটির শেড, মেশিনপত্রসহ ভাড়া দেওয়া হয়েছে টিএস লেভেল কর্তৃপক্ষকে।
হলমার্কের সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, গ্রেপ্তারের কিছুদিন পরই জামিনে বের হয়েছিলেন জেসমিন ইসলাম। ওই সময় তিনি কিছু মেশিন ও অন্যান্য সামগ্রী বিক্রি করেছিলেন। এরপর থেকে হলমার্কের কারখানাগুলো থেকে স্থানীয় প্রভাবশালীরা নিয়মিতভাবে মেশিনারিজসহ বিভিন্ন স্থাপনা ও মূল্যবান মালপত্র বেচতে শুরু করেন।
হলমার্কের যেসব উন্নতমানের মেশিনারিজ ছিল, চাইলে সব কটি কারখানা আবার সচল করা যেত। কিন্তু এখন আর সেটা সম্ভব নয়। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখন জমি আর পরিত্যক্ত ভবন ছাড়া তেমন কোনো মেশিনারিজ নেই।
হলমার্ক গ্রপের ম্যানেজার আব্দুল হক বলেন, হলমার্কের বিপুল পরিমাণ সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ এবং দেখভালের জন্য অনেক নিরাপত্তারক্ষী দরকার, কিন্তু টাকার অভাবে রাখতে পারছি না। প্রতিদিনই চুরি হচ্ছে, বিষয়টি থানা-পুলিশকেও জানিয়েছি।
তিনি আরো বলেন, ‘বর্তমানে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আমাদের বেশ কিছু জমি ও স্থাপনা থেকে ভাড়া আদায় করছে এবং আমরাও হলমার্ক গ্রুপের কারখানাগুলো ভাড়া দিয়ে নিরাপত্তা রক্ষীসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, হলমার্ক গ্রুপের এমডি জেসমিন গ্রেপ্তারের পর তাঁর ভাই শামীম আল মামুন এই কারখানাগুলোর নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। পরে শামীমকে হটিয়ে কারখানার নিয়ন্ত্রণ নেন সাভার উপজেলার চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজীব ও তাঁদের অনুসারীরা। প্রায় প্রতি রাতেই ট্রাক ভরে এসব মালপত্র সরিয়ে নেন রাজীব ও তাঁর অনুসারীরা।
হলমার্ক গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার শামীম আল মামুন বলেন, ‘আমি মূলত মামলার বিষয়গুলো দেখি। এখানে কী হয়েছে তা সবাই জানেন। গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক কারাবন্দি। জামিনের চেষ্টা করছি।’