আব্দুর রব, বড়লেখা (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি: বড়লেখার সাবাজপুর টি কোম্পানী লিমিটেডের ইজারাকৃত ভূমি সংলগ্ন খাস জমির বাসিন্দারা অবৈধভাবে বাগানের ভূমি জবর-দখলের অপচেষ্টা চালাচ্ছে। গত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে স্থানীয় দখলদার বাহিনী সীমানা নির্ধারণ না থাকার অজুহাতে অবৈধভাবে ঝুপড়িঘর তৈরী করে ক্রমশ বাগানের ভূমি গ্রাস করছে। সম্প্রতি (২৭ সেপ্টেম্বর) সরকারিভাবে সীমানা নির্ধারণের সরকারি জরিপ শুরু হলে ভূমি খেকোচক্র ভয়ভীতি দেখিয়ে তা বন্ধ করে দিয়েছে। এতে জরিপে নিয়োজিত সেটেলম্যান্ট কর্মকর্তা, সার্ভেয়ার, ড্রাপ্টসম্যানসহ অন্তত ৩০ কর্মকর্তা-কর্মচারী বসে থেকে সময় পার করছেন।
জবর-দখল অপচেষ্টা অব্যাহত ও জরিপ কাজে বাধা প্রদানের ব্যাপারে সাবাজপুর চা বাগানের উর্ধ্বতন ব্যবস্থাপক মো. নাহিদ ফেরদৌস চৌধুরী ২২ অক্টোবর জেলা প্রশাসক ববারব লিখিত অভিযোগ করেছেন।
জানা গেছে, ২০০৭ সালে উপজেলার সীমান্তবর্তী দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নের এই চা বাগানের ২৮৮৬.১১ একর জমি ইজারা নেওয়ায় মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসন স্কয়ার গ্রুপকে তা বুঝিয়ে দেয়। বাগানের ইজারাকৃত ভূমির পূর্বসংলগ্ন সংরক্ষিত বনের ভূমি, যা সরকারি। ২০২২ সালের ১৮ জুন বাগানের নিকটবর্তী বোবারথল এলাকার দেড় ১০০/১৫০ ব্যক্তি বাগানের লীজের ভূমির কিছু অংশ দখলে নেওয়ার অপচেষ্টা চালায়। চা বাগানের টিলার ওপর ঝুপড়ি ঘর তৈরী করে। জঙ্গল পরিস্কার করে কিছু অংশে বিভিন্ন ফলফলাদির চাষ শুরু করে। এভাবে গত দুই বছরে দখলদার বাহিনী বেশ কয়েকটি ঘর তোলে, রাস্তা বানিয়ে, গাছপালা লাগিয়ে প্রায় ৬শ’ একর ভূমি অবৈধভাবে দখল করে নেয়। সরকারি রাজস্ব প্রদান সত্ত্বেও এই ভূমিতে বাগান কর্তৃপক্ষ যেতে পারছে না। চা শ্রমিকরা গেলে দখলদাররা মারধরসহ নানাভাবে হয়রানি করছে। ইতিপূর্বে বাগানের ট্রাক্টরচালক মালেক ও মনসুরকে পিটিয়ে জখম করেছে।
অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ দখলদারদের নেতৃত্বে থাকা আরমুজ আলী, নিয়াজুর রহমান, ইব্রাহিম আলী, আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুর রহমান, কয়েছ উদ্দিন, আলী হোসেন, নিজাম উদ্দিন প্রমুখকে প্রশ্রয় দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক এক মন্ত্রী, সাবেক দুই জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় কয়েক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা। এতে দখলদাররা বেপরোয়া হওয় উঠে। দখলদাররা মূলত শাহবাজপুর ইউনিয়নের বোবারথল, ইসলামপুর, দক্ষিণ গান্ধাই ও মাঝ গান্ধাই গ্রামের বাসিন্দা। এদের প্রত্যক্ষ শেল্টারে গ্রামগুলোর অর্ধশতাধিক পরিবার বাগানের ২৫টি দাগের প্রায় ৬শ’ একর এলাকাজুড়ে অবৈধ ঘর তুলেছে। কিছু অংশে পানের জুম, কলাবাগানসহ বিভিন্ন ধরণের সবজি চাষ করে ভোগ করছে। বাগান কর্তৃপক্ষ ওই এলাকায় গেলে পাশের গ্রামের আত্মীয়স্বজনরা দলবেধে তেড়ে আসে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পূর্বদিকে বাগানের লীজের একাধিক টিলার ওপর ১/২টি করে নতুন ঘর নির্মাণ করেছে। কিছু টিলা পরিস্কারের কাজ করছে দলখদারদের শ্রমিকরা। আশপাশে লাগানো হয়েছে কলাগাছ। কিছু অংশে রোপণ করা হয়েছে নানা জাতের সবজি। টিলার নিচ কেটে নির্মাণ করা হচ্ছে রাস্তা।
চা বাগান ব্যবস্থাপক নাহিদ ফেরদৌস চৌধুরী জানান, শাহবাজপুর মৌজার ৪২৮টি দাগে ২ হাজার ৮৮৬.১১ একর জমি ২০০৭ সালে মৌলভীবাজার জেলা রাজস্ব বিভাগ তাদের বুঝিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে ৮০৮.২৬ একর জমিতে চা বাগান, ৩৩০ একরে রাবার, আগর বাগানসহ প্রায় ১ হাজার ৯০০ একর ভূমি আবাদের আওতায় রয়েছে। এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছর সরকারকে লাখ লাখ টাকা রাজস্ব দিচ্ছে। তিনি আরো জানান, টি বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিবছর লীজকৃত ভূমির আড়াই শতাংশ হারে নতুন চায়ের প্ল্যান্টেশন করতে হয়। দখলদার চক্রের কারণে তারা সেই নির্দেশনা পালন করতে পারছেন না। এর জন্য বাগানকে জরিমানা গুনতে হচ্ছে। নতুন বাগান তৈরি করতে না পারায় লাখ লাখ কেজি চা পাতা উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে সরকারেরও রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে।
চা বাগানের আইন কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম জানান, পাঁচটি মামলা করেও দখলদারদের দৌরাত্ম্য থামানো যায়নি। পুলিশের ওপর হামলার একটি মামলাও রয়েছে। তবে দখলদার চক্রটি নারী নির্যাতনসহ দুটি মামলা দিয়ে বাগান কর্তৃপক্ষকে হয়রানি করছে। তিনি আরও জানান, সমস্যা সমাধানে একাধিকবার তারা সার্ভের মাধ্যমে চা বাগানের সীমানা নির্ধারণে চেষ্টা করেছেন। তবে, নানা অজুহাতে তা করতে দেয়নি দখলদাররা। সর্বশেষ ২৭ সেপ্টেম্বর উভয় পক্ষের সার্ভেয়ারের উপস্থিতিতে জরিপ শুরু হলে এবারও তা ভন্ডুল করে দেয়।
বাগানের জমি দখলের ব্যাপারে অভিযুক্ত আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুর রহমান, শরফুউদ্দিন, কয়েছ উদ্দিন প্রমুখ জানান, তারা চা বাগানের নয়, সরকারি খাস জমিতে ঘর নির্মাণ ও সবজি চাষ করছেন। লীজের জন্য তাদের আবেদন করা আছে। তবে, লীজ পাওয়ার কিংবা মালিকানা সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র তাদের কাছে নেই। সার্ভে করে চা বাগানের জমি প্রমাণ হলে, তারা চলে যাবেন। তবে জরিপে বাধা দেওয়ার প্রশ্নের জবাবে বলেন জরিপে নিয়োজিত সরকারি লোকজনকে চা বাগানের বাংলোয় রাখায় তারা বাগানে না থাকতে বলেছেন। তবে, ইউএনও গত ১৩ নভেম্বর উনার কার্যালয়ে চা বাগান পক্ষ ও আমাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। আগামি ২৩ নভেম্বর পুনরায় জরিপ কার্য শুরু করার ব্যাপারে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছি।
স্কয়ার গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ের ডিজিএম মেজর নুরুজ্জামান (অব.) বলেন, অবৈধ দখলদারা তাদের রোপিত কয়েক হাজার চা গাছ নষ্ট করেছে। দীর্ঘদিন ধরে প্রায় ৬শ’ একর ভূমি বাগান কর্তৃপক্ষকে ঢুকতে দিচ্ছে না। ওই এলাকায় থাকা গাছ ও বাঁশ কেটে বিক্রি করছে। এতে বাগান কর্তৃপক্ষ বড় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে।
বড়লেখা ইউএনও তাহমিনা আক্তার জানান, সাবাজপুর চা বাগানের বেশ কিছু ভূমি বেহাতের অভিযোগ পান। সীমানা নির্ধারণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চা বাগান ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে বিরোধ চলছিল। সরকারিভাবে জরিপ কাজ শুরু হলে বাধায় তা বন্ধ হয়ে যায়। তবে, বিষয়টি সমাধানের জন্য গত ১৩ নভেম্বর তার কার্যালয়ে উভয় পক্ষকে নিয়ে বৈঠক হয়। আগাী ২৩ নভেম্বর এসিল্যান্ডের মধ্যস্থতায় বোবারথলের দখলদারগন ও সাবাজপুর চা বাগানের সরকারী লীজকৃত ২৮৮৬.১১ একর সীমানা নির্ধারণ দ্বিপাক্ষিক জরীপ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। পরবর্তীতে পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্ট মৌজা জরিপ সম্পন্ন হওয়া সাপেক্ষে যখন ২ মৌজার সীমানা পুনঃনির্ধারিত হবে, ততদিন দখলদাররা গাছ-বাঁশ কাটা, পাহাড় পরিস্কার করে পান-কলাগাছ লাগানো কাজ থেকে বিরত থাকবে। এ বিষয়টি স্থানীয় সেনা ক্যাম্প তদারকি করছে।