শফিকুল ইসলাম মিন্টু, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি: ময়মনসিংহের গৌরীপুরে সমাজের অবহেলিত-নির্যাতিত ও নিপীড়িত নারীদের ভাগ্য বদলে কাজ করছেন একদল নারীকর্মী। তাঁরা কৃষাণ-কৃষাণীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিত্যক্ত জমিতে ফসল উৎপাদন, ফসলের রোগবালাই দমন ও বসতবাড়িতে পরিকল্পিত সবজি চাষ করে স্বাবলম্বী হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। তাঁরা হলেন এ্যাডরা বাংলাদেশের কমিউনিটি এম্পাওয়ারমেন্ট প্রজেক্টের অধীনে নারীকর্মী। নার্স বা ডাক্তারের ন্যায় সাদা এপ্রোন পড়ে ছুটে চলেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে। কৃষাণ-কৃষাণীদের ঘরে-বাইরে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে দিনরাত পরিশ্রমী এই নারী কর্মীরা এলাকায় এখন ‘ফসলের ডাক্তার আপা’ নামে পরিচিত।
প্রকল্পের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী জানান, উপজেলার বোকাইনগর, রামগোপালপুর, অচিন্তপুর, মইলাকান্দা, ২নং গৌরীপুর, মাওহা, ডৌহাখনা ও সহনাটী ইউনিয়নের ৯৮টি গ্রামে এই নারী কর্মীরা কাজ করছেন। মহিলা সমিতির সংখ্যা ১০০টি। সদস্য সংখ্যা ৪হাজার ২৫০জন। তাদের মধ্যে সবজি বাগানে ১৭৯জন, ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদনে ৩৮২জন, আইল ফসল ২০৯জন, নিবিড়ায়ন পদ্ধিতিতে ধান চাষে ৩২৫জন ও জলবায়ু সহিষ্ণু সবজি চাষের ১৬৭জন কাজ করছেন। একমাসে ১৬হাজার ৫৫০ কেজি ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন করে জেলায় সর্বোচ্চ রেকর্ড অর্জন করেছে।
আইল ফসল উৎপাদন করে ভাগ্যের চাকা বদলে দিয়েছেন ৩শ ২৮জন গৃহিনী। তাদেরই একজন মিনা বেগম। তিনি উরুয়াকোনার শাহজাহান মিয়ার স্ত্রী। নিজ জমির আইলে প্রায় ৬হাজার টাকা খরচ করে ইতোমধ্যে ২০হাজার টাকা ফসল বিক্রি করেছেন। আরো ৭/৮হাজার টাকার বিক্রি হবে বলে তিনি জানান। অতিরিক্ত এ আয়ে মিটে যাচ্ছে দু’সন্তানের স্কুলের খরচ। রামগোপালপুরের আব্দুল্লাহর স্ত্রী ফাতেম খাতুন জানান, তিনি আইলে ফসল উৎপাদন করে বেশ লাভবান হয়েছেন। তার দু’ছেলে ও এক মেয়েও স্কুলে যাচ্ছে। এসব আইলে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বরবটি চাষ। এছাড়াও উৎপাদন হচ্ছে লাউ, সিম, পুঁইশাক, ঢেঁড়শ।
অপরদিকে পুকুরপাড়ে সবজি চাষে সাফলতা পেয়েছেন মইলাকান্দা ইউনিয়নের লামাপাড়া গ্রামের সাইফুল ইসলামের স্ত্রী পারভীন বেগম। এসব নারীদের বাড়তি আয়ে বদলে গেছে পরিবারের আর্থসামাজিক অবস্থান। এ ইউনিয়নের কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজার (সিডিও) তন্ময় রায় জানান, এসব জমির আইল পরিত্যক্ত ছিলো, এখন সবুজে ছেয়ে গেছে। বাড়তি আয়ে-পরিবারের স্বচ্ছলতাও এসেছে। রামগোপালপুর ইউনিয়নের কমিউনিটি ডেভেলাপমেন্ট অর্গানাইজার (সিডিও) সীমা রানী দে জানান, যতদূর চোখ যায়, ততদূর আমরা ধান ক্ষেতে সবজির দেয়াল করে দিয়েছি। এ অঞ্চলের গৃহিণীরা অতিরিক্ত মুনাফা পাচ্ছে। অনুন্নয়ন আর পিছিয়ে পড়া এসব নারীদের কারিগরী সহযোগিতা ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে নতুন পথ দেখাচ্ছেন এ্যাডরা বাংলাদেশের কর্মীরা। এসব পদ্ধতিতে ৬শ ৫৪জন নারী আজ খোঁজে পান ক্ষুধা আর দারিদ্রতা বিমোচনের নতুন পথ।
বন্যা ও জলাবদ্ধ এলাকার কৃষকদের জন্য এবার নিয়ে এসেছে জলাবদ্ধতায় সবজি চাষের নতুন এক পদ্ধতি। যার নাম ‘টাওয়ার পদ্ধতি’। এ পদ্ধতি বিস্তারে নারী কর্মীরা ছুটে চলছেন কৃষকের দোরগোড়ায়। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে বন্যা কবলিক বা বর্ষা মৌসুমে কৃষকরা পানিতেই সবজি চাষ করছেন।
পরীক্ষামূলক এ প্রকল্পে সফলতা আসায় এবার তা সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে ফলদ বৃক্ষ মেলায় এই টাওয়ার পদ্ধতি প্রদর্শিত হচ্ছে। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে টাওয়ারও উপরে উঠে যায়। পানি বাড়লেও ফসলের কোন ক্ষতি হবে না বলে জানান প্রশিক্ষক নাসরিন আক্তার। উপজেলা কৃষি বিভাগ জানায়, এ পদ্ধতি ছড়িয়ে গেলে পরিত্যক্ত জমিতে অতিরিক্ত ফসল উৎপাদন হবে। জলবায়ু সহিষ্ণু চাষাবাদ পদ্ধতি’র আওতায় তাদের আবিস্কার এখন ‘টাওয়ার’ পদ্ধতি।
রাস্তার ধারে, পুকুরপাড়ে ও বসতভিটায়, ধানের ক্ষেতে আইলে সবজি চাষ ছাড়াও এ সংস্থার মাধ্যমে সেলাই মেশিন, ধাত্রীবিদ্যা এবং ব্লকবাটিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। প্রশিক্ষক রোকসানা পারভীন জানান, আমরা পদ্ধতি ও কৌশল দিচ্ছি, নারীরা শ্রমের মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছেন।
নারীদের ভাগ্যবদলের এ কাজে নিয়োজিত আছেন কমিউনিটি ডেভোলাপম্যান্ট অর্গানাইজার হাওয়া আক্তার, শিখা দেবনাথ, নাদিমুল হাসান, শিরিনা আক্তার, সুমাইয়া আক্তার, হাফিজা খাতুন, মালা বসাক, তানজিলা তাবাসসুম, লাজিতা চাম্বু গং, সুব্রত সরকার, দুলাল মিনজী, কমিউনিটি ওয়ার্কার সোমা দে, মৌসুমী সাহা, শিমা আক্তার, দ্বিপালী দাস, লিমা আক্তার, কানিজ ফাতেমা, ফাহিমা খাতুন, জান্নাতুল ইসলাম, তানিয়া আক্তার।