মোঃ ইব্রাহীম মিঞা, বিরামপুর(দিনাজপুর)প্রতিনিধি: সারাদিনের মধ্যে ভাপা পিঠার প্রয়োজনীয় সব কিছু জোগাড় করে বিকেল থেকে দিনের আলোয় কাজ করছেন মমতাজ বেগম। আর সন্ধ্যা নামতেই কৃত্রিম আলো জ্বালানো হলে পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। পিঠার দোকানের কাছেই ক্রেতারা অপেক্ষা করছেন। দিনাজপুর-গোবিন্দগঞ্জ মহাসড়কের বিরামপুর মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স এলাকায় এভাবে গরম চুলোয় পিঠা তৈরি করে বিক্রয় করতে দেখা যায়।
দেশের উত্তরাঞ্চলসহ কয়েকটি জেলায় শীতের প্রকোপ বেশি হয়ে থাকে। শীতের আগমনী বার্তা পেয়ে পিঠা বিক্রেতাদের পরিবারে সুখের দিন ফিরে আসে।ভোররাত থেকে কুয়াশার সঙ্গে কিছুটা শীত এবং বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার আগে শীত অনুভব করা যায়।তারপরও শীতের এই আমেজকে ভিন্ন মাত্রা এনে দেয় পিঠা। পিঠা বাঙালি সংস্কৃতির এক অংশ। শীতের সকাল ও সন্ধ্যায় পিঠা খাওয়া গ্রামের চিরায়ত দৃশ্য হলেও এমন দৃশ্য পৌরশহরে চোখে পড়ে। ব্যস্ত শহুরে জীবনে ঘরে পিঠা তৈরি করা কষ্টসাধ্য হলেও রাস্তার পাশে ও মোড়ের দোকানে পিঠা পাওয়া যায়। তাই শীত মৌসুমে পৌরশহরের বিভিন্ন এলাকায় পিঠার দোকান গড়ে ওঠে।
এ বছরও শীতকে ঘিরে পৌরশহরে মৌসুমি পিঠা বিক্রেতাদের প্রস্তুতির কমতি নেই। দিনভর পিঠার আটাসহ অন্যান্য উপকরণ তারা তৈরি করেন। আর বিকেল হলেই রাস্তার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হরেক রকমের পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। রাত ১০টা পর্যন্ত সেই পিঠা বিক্রি চলে। আর পিঠা বিক্রির আয়েই এসব খেটে খাওয়া মানুষের সংসার চলে। বলা যায়, শীত মৌসুমে তিন মাস পিঠা বিক্রি করেই তারা উপার্জন করে থাকেন।
বিরামপুর উপজেলার, কলাবাগান মোড়, হাসপাতাল মোড় , মহাসড়কের পাশে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স এর পশ্চিমে,অবসর সিনেমা মোড়, পশু হাটের মোড়, থানার রাস্তার মোড়সহ পূর্ব পাড়া,ইসলাম পাড়ার এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন অলিতে গলিতে বিকেল থেকেই পিঠা বিক্রেতারা রাস্তার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান করেন। কেউ ভ্যানে করে আবার কেউ নির্দিষ্ট স্থানেই শীত মৌসুমে পিঠা বিক্রি করেন। পরিবারের কাজকর্ম শেষ করে বেশিরভাগ অসহায় দরিদ্র পরিবারের নারীরা এ পেশায় ব্যাস্ত হয়ে পড়েন।পিঠা বিক্রির টাকায় এ স্বল্প আয়ের মানুষগুলোর সংসার চলে। শীত শেষ হলে অনেকে অটোরিকশা চালানো কিংবা অন্য কোনো দিন মজুরির কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন।
স্বামী সন্তান সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় পিঠা বিক্রি করছেন জাহানারা ।এসব নারীদের কারোর স্বামী নেই আবার স্বামী থাকলেও অসুস্থ। তাই সংসার চালাতে শীত মৌসুমে পিঠা বিক্রি করছেন। এসব দোকানে শীতের বিভিন্ন প্রকারের পিঠা দেখা যায়। এর মধ্যে ভাপা আর চিতই পিঠার দোকানই বেশি চোখে পড়ে। এর পাশাপাশি সিদ্ধ ডিম,পিঁয়াজু,পাটিশপটা,মুগের ডালের পাঁপড় ভাজা, তেল পিঠাসহ হরেকরকম পিঠার পসরা সাজিয়ে রেখেছেন।চিতই পিঠা খাওয়ার জন্য ভর্তা হিসেবে রয়েছে তিল,ঝাল, বাদাম ও ধনা পাতার এছাড়াও রয়েছে গুঁড়।
পৌরশহরে সন্ধ্যা নামতেই পিঠার দোকানগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় বাড়তে থাকে। অনেক সময় একজনের পক্ষে পিঠা তৈরি করে বিক্রি করতে হিমশিম খেতে হয়। একাধিক চুলায় পিঠা তৈরি করেও ক্রেতাদের চাহিদা পূরণ কঠিন হয়ে যায়। এ সময় পিঠা বিক্রেতা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে অনুরোধও করেন। অনেকে বাড়ির সদস্যদের জন্যও পিঠা নিয়ে যান। আর বেশিরভাগ ক্রেতাই গরম পিঠা খাওয়ার জন্য দাবি করেন বলে তাদেরকে অপেক্ষা করতে হয়। এসব পিঠার দোকানে রিকশাচালক থেকে শুরু করে দিনমজুর, শিশু-কিশোর, চাকরিজীবী, শিক্ষার্থী সব শ্রেণি-পেশার মানুষই আসেন। পিঠা বিক্রেতারা জানান, চালসহ অন্যান্য দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি হলেও পিঠার দাম বাড়েনি।
কলাবাগান মোড়ের পিঠা বিক্রেতা নওশাদের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, বিকেল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত একশ থেকে ১৫০টি পিঠা বিক্রি করা যায়। প্রতিদিন একইরকম বিক্রি হয় না। কোনোদিন একশটি পিঠাও বিক্রি করা কঠিনে হয়ে যায়। এখন তো সবখানেই পিঠা পাওয়া যায়।
পিঠার দামের বিষয়ে এ বিক্রেতা বললেন, সাধারণত ১০টাকা দামেই পিঠা বিক্রি করি। কেউ কেউ ২০ টাকার পিঠার কথা বললে সেটাও তৈরি করি। তবে ১০টাকার পিঠাই বেশি বিক্রি করি। দিনে এক থেকে দেড় হাজার টাকার পিঠা বিক্রি হলে পাঁচ থেকে সাতশ টাকা লাভ থাকে। কোনো কোনো দিন আবার পাঁচশ টাকাও হয় না।
কয়েকজন অটোরিকশা চালক পিঠা খেতে এসেছেন বিরামপুর মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স এর পশ্চিমে।পিঠার দোকানের সামনে তাদের সঙ্গে কথা হয়। অটোরিকশা চালক হারুন বলেন, সন্ধ্যা হলেই বাইরে বের হই আমরা। এখন শীতের সময় ভাড়া মারার ফাঁকে সময় করে পিঠা খেতে আসি। এছাড়াও জিনিস পত্রের যে দাম বাসায় তৈরি করে খাওয়ার তেমন সুযোগ হয়না তাই এই পিঠার দোকানই শেষ ভরসা। পিঠা ভালো লাগলে যে যার মতো করে আমরা পিঠা খাই। তারপরও বাড়িতে তৈরি পিঠার স্বাদ এখানে পাওয়া যায় না।
পরিবারের সাথে পিঠা কিনতে আসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী রোখসানা বলেন, গ্রামে বেড়াতে গেলে নানীর হাতের পিঠা খেতাম। কিন্তু শহরে সেই সুযোগ আর কোথায়। প্রায়ই বাবার সঙ্গে বাহিরে শীতের সময়ে পিঠা খাওয়া হয়।
বিরামপুর উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা মোশাররত জাহান এর সাথে মুঠোফোনে নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন নারীরা তো আর পিছিয়ে নেই। শীতকালে নিজ এলাকায় বিভিন্ন ধরনের পিঠার দোকান দিয়ে তাঁরা আয় করছেন। সরকারের পক্ষ থেকে যদি তাঁদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে আরও কোনো সুযোগ তৈরি করা যায়, তাহলে সেটি আরও ভালো হবে বলে তিনি জানান।