ছায়েদ আহমেদ, হাতিয়া (নোয়াখালী) প্রতিনিধি: নিঝুম দ্বীপ জাতীয় উদ্যানের চর ওছমান বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। অবশিষ্ট ধ্বংসাবশেষের ওপরও চলছে দিনেদুপুরে বনদস্যুদের কুঠার আঘাত। কেউ কুঠার-করাত দিয়ে কাটছে আর কেউ বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। সংরক্ষিত বনটির উজাড় হওয়া ভূমির ফাঁকে ফাঁকে যে কয়টি গাছ রয়েছে তার ভিতর চলছে ধান চাষ, মাইল জুড়ে বালি টাল করে চলছে রমরমা ব্যবসা। আবার সেই ভূমিখেকোদের উজাড় করা চর'কে চারণভূমি হিসেবে ব্যবহার করে চরানো হচ্ছে তাদেরই মহিষ, গরু আর ভেড়া। দেখার কিংবা বারণ করার যেন কেউ নেই। এ যেন অরক্ষিত রাজ্যের এক অরাজক পরিস্থিতি।
বনায়ন ধবংসের এমন এক ভয়াবহ দৃশ্য দেখা গেছে নিঝুম দ্বীপ জাতীয় উদ্যানের চর ওছমানে। যা নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ১০নং জাহাজমারা ও ১১নং নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়নের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত।
মরুভূমির ন্যায় বন'টি সরেজমিনে অনুসন্ধানে গেলে প্রতিবেদকের নজরে আসে বনের ওপর বনদস্যুদের আক্রমণের দৃশ্য। জাতীয় উদ্যানের এ বনের ধ্বংসাবশেষের ওপর দিনেদুপুরে একদল বনদস্যুর এমন কুঠার আঘাত চালাতে দেখে তাৎক্ষণিক সংশ্লিষ্ট জাহাজমারা রেঞ্জ কর্মকর্তা ছাইফুর রহমান কে অবহিত করা হয়। এসময় তিনি জানান, গাছ কাটা তো নতুন কিছু না, তবে দিনেদুপুরে কাটা খুবই দুঃখজনক। পরে তার স্টাফদের ঘটনাস্থলে পাঠাবেন বলে জানান তিনি।
গাছ কর্তনকারী সংঘবদ্ধ টিম প্রতিবেদকের হাতে থাকা ক্যামেরা দেখে পালাতে থাকে। আশপাশে থাকা লোকজন থেকে জানতে চাইলেও তারা কেউ কারো নাম প্রকাশ করছেন না। ঘটনাস্থলে থাকা জাহাজমারা ১নং ওয়ার্ডের সোহান এবং ২নং ওয়ার্ডের সোহেল জানান, যারা বন্দোবস্ত নিয়েছে তারা রাতে গাছ কেটে রেখে যায়। এবং দিনের বেলা অন্যরা এসে নিয়ে যায়। কাটাখালি এলাকার দশ বছর বয়সী জেলে রবিন জানান, বাগান দখলকারীরা গাছ কেটে ধান চাষ করে। গাছের নিচে বাকল ছেটে যায়, এতে গাছ মরে গেলে অন্যরা নিয়ে যায়।
বালি ব্যবসায়ী কালু মিয়া এবং আলমগীর জানান, যারা গাছ কেটে বনের জায়গা দখল করেছে তাদেরকে ভাড়া দিয়ে আমরা বালি রেখেছি।
গেল বছরের শুরুতে চরটির বাগানে গিয়ে এর অবস্থান মোটামুটি লক্ষ্য করা গেলেও এবার তার করুনঘন পরিস্থিতি দেখা যায়।
এদিকে, বনবিভাগের নামে সরকারি গেজেটভুক্ত বিভিন্ন চরের বনভূমি স্থানীয় ভূমি অফিস কৌশল খাটিয়ে ভিন্ন ভিন্ন নামকরণ করে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে বন্দোবস্ত দেয়।
যদিও সংরক্ষিত বনভূমি জবরদখল নিরসনের জন্য হাইকোর্টে রিট পিটিশন (৭১৪৫/২০১৪) দায়ের করা আছে। যাতে সংরক্ষিত এলাকায় বনভূমি বন্দোবস্ত প্রদান না করা এবং বন্দোবস্ত করা হলে তা বাতিল করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবুও সরকারি বন এলাকার গাছ কেটে জমি দখলে নিয়ে ভূমি অফিস গোপনীয় ভাবে বনভূমি বন্দোবস্ত দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে বনবিভাগের।
নোয়াখালী উপকূলীয় বনবিভাগের ২২.০১.৭৫০০.৫৭৯ স্মারকে উল্লেখ করা হয় ২০১৭-১৮ থেকে ২০২১-২২ পর্যন্ত জাহাজমারা রেঞ্জ কর্তৃক হাতিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার(ভূমি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বরাবর কয়েক ধাপে পত্র দেওয়া হয়।
স্মারকে উল্লেখ করা হয়- জাহাজমারা রেঞ্জের ৪টি বিটে গেজেট ভুক্ত ২১ লাখ ৪৪ হাজার ২৯ একর বনভূমি ও ৪০ হাজার তিনশত ৯০ একর জাতীয় উদ্যান এলাকা রয়েছে। দখলদারদের কারনে যা এখন চারোদিক থেকে ছোট হয়ে এসেছে।
হাতিয়া উপজেলা ভূমি অফিস যে কৌশলে ভিন্ন ভিন্ন নামকরণের মাধ্যমে বনবিভাগের ভূমি বন্দোবস্ত দেয়- জাহাজমারা সদর বিটের চর ইউনুস এর সাথে সংযুক্ত চরহেয়ার নাম দিয়ে, হরিণের চারণভূমি নিঝুম দ্বীপ-( চর ওছমান বীটের চর কমলা অংশকে চর মাহিদ নাম দিয়ে এবং বন্দরটিলাকে চর ওছমান মৌজা বলে), চর বাহাউদ্দিনকে দমার চর নাম দিয়ে, চরকালাম পুরানের বাইরে বর্ধিত মো.পুর ও বর্ধিত বিরবিরি বলে ২টি মৌজা এবং বনবিভাগের রেকর্ডে চর রওশন এর পাশের অংশ কে চর মিজান নামে বন্দোবস্ত দেয় ভূমি অফিস। এতে ব্যাপক হারে বনায়ন যেমন উজাড় হচ্ছে তেমনি ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের প্রতিবন্ধকতাও উঠে যাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে ভারসাম্য হারাতে বসেছে পরিবেশ, বিপন্ন হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। যার বাস্তবিক প্রমাণ- যেখানে দেখা যেতো অগণিত হরিণের বিচরণ এখন তা শূন্যের কোটায়। মানুষের অকৃত্রিম ভালবাসার এ মায়াবী হরিণের এমন আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পাওয়া বনায়ন ধ্বংসের-ই ফল বলে উল্লেখ করেন স্থানীয় সচেতন মহল।
বন ধ্বংসের ব্যাপারে জাহাজমারা বিট কর্মকর্তা বোখারী আহমদ জানান, ২০২২ সাল থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৮টি বন মামলা হয়েছে এবং একটি পুলিশ এজাহার করা হয়েছে।
বনায়নের গেজেটভুক্ত চর সমূহকে ভিন্ন নামে বন্দোবস্ত দেওয়া প্রসঙ্গে হাতিয়া উপজেলা বর্তমান সহকারী কমিশনার(ভূমি) মং এছেন বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি সম্পর্কে পদক্ষেপ নেব।
নোয়াখালী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু ইউসুফ জানান, প্রতিদিন বন কাটার ঘটনায় তদন্ত টিম পাঠিয়ে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।