ব্যস্ততার মাঝে মোবাইল ফোনটা বেজে উঠতেই লাইনটা কেটে দেওয়া হলো। ঘন্টা খানেক বাদে ফের ফোন কল। অজানা নাম্বার। সতর্কিত ব্যক্তি বেশ কিছুদিন আগে প্রকাশিত এক সংবাদ প্রতিবেদনের কপিটা হাতে নিয়ে মিলিয়ে নেবার চেষ্টা করলো নাম্বার টা সাইবার চক্রের কিনা? হ্যাঁ বিষয়টা সেরকমই। পরের ঘটনা, দুপুর গড়িয়ে বিকাল। খাওয়া দাওয়া সেরে বিশ্রাম নিতে যাবেন, অমনি একটা ফোন কল আপনার বিকাশ বা নির্দিষ্ট ব্যাংকের এ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত নানা তথ্য নিয়ে বিচলিত করার চেষ্টা করছে।
কিন্তু তাতে সায় না পেয়ে অপর প্রান্ত থেকে হুট করে কেটে গেল ফোন লাইন। এর কিছুক্ষণ পরে আরেকটি নাম্বার থেকে আবার এল ফোন কল। এক তরুণী বলছিলেন, "স্যার আপনার হিতার্থে আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই। আপনার ছেলের স্কুলের উপবৃত্তির টাকা উত্তোলনের সুবিধার জন্য কয়েকটি নিয়মনীতি জানানোর জন্য এই ফোন।" লোকটি বিপদের আঁচ করতে পেরে দিলেন লাইন কেটে।
তার পরের ঘটনা অনলাইনে কিছু একটা কাজ করছিলো যুবক। হঠাৎ দুটো মেসেজ প্রায় একসাথে চলে এলো ইমেইলে। সাথে একটি ওয়েব লিঙ্ক। সেই সাথে ক্লিক করার আবেদন। সতর্কিত যুবক বুঝতে পারলো সাইবার অপরাধের ফাঁদ। কারণ,এই ধরনের চাকরি সংক্রান্ত মেসেজ সুনির্দিষ্ট দপ্তর বা অফিসের ওয়েবসাইট ছাড়া আসার কোন কারন থাকতে পারেনা।
প্রাসঙ্গিক এই ঘটনাগুলোর সাথে মুখোমুখি হয়েছেন বহু মানুষ। সর্বস্বান্ত হচ্ছেন বহুজন। সামান্য একটা ভুলে বলা যায়,এই ভুলটা ঘটে অসর্কতায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন,অচেনা অজানা ফোন নম্বরে তথ্য আদান প্রদান বা ফোন কল বা ওয়েব লিঙ্ক ব্যবহার না করার জন্য। প্রচুর ভুয়া লিঙ্ক ওয়েবসাইটের আষ্টেপৃষ্টে লেপটে আছে সরকারী বা বেসরকারী অফিস বা প্রতিষ্ঠানের নামে। প্রয়োজন ভালো করে যাচাই করার। কোন রুপ সন্দেহ হলে সাহায্য নেয়া যাবে পুলিশের সাইবার সেলের। কিন্তু কথা হলো নির্দিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নামে যে ফোন কল গুলো ব্যাংকের বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের কাছে আসে সেক্ষেত্রে সাইবার অপরাধী এই তথ্য টা কিভাবে সংগ্রহ করে যে গ্রাহকের এ্যাকাউন্টে ওই নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আছে?এই তথ্য টা তাদের কাছে পৌঁছায় কিভাবে? বর্তমানে এমন অনেকেই আছেন যাদের দুইতিনটা ফোন নাম্বার আছে। কিন্তু কোন নাম্বার টা কোন ব্যাংক একাউন্টের সাথে যুক্ত সেটাও বা সাইবার অপরাধীদের কাছে পৌঁছে কি করে?
এই ফোন নাম্বার গুলো কোন না কোন ভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান গুলো থেকে ফাঁস হচ্ছে নাতো আউটসোর্সিং এর হাত ধরে!সাইবার প্রতারণা শিকারের ঘটনাগুলো ক্রমান্বয়ে যদি কেউ ঘেঁটে থাকেন তবে দেখা যাবে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বরাবরই সাইবার হুমকির মুখে রয়েছে। এবং এই হুমকি আসলে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সমুহের গ্রাহক বা কাষ্টমারের ফোন নাম্বারে আসা একটা অচেনা ফোন কল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফোন কল করে নানা অজুহাতে তথ্য আদান প্রদানে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। অপরাধের তদন্তে গিয়ে ভাবচ্যাকা খেতে হচ্ছে তদন্তকারীদেরও। দেখা যায়, মোবাইল টাওয়ার লোকেশন বলছে, অমুক জায়গা এবং ওই জায়গা থেকে কেউ একজন ফোন কল করেছেন কিন্তু সিমটা যার নামে সেই নামের ব্যক্তি থাকেন অন্য এক জায়গায় অর্থাথ ভুয়া সিম ব্যবহারে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে একের পর এক।
এটা অনেকেরই জানা আছে, বর্তমান সময়ে সিমকার্ড ক্রয় বিক্রয়ে রয়েছে যথেষ্ট কড়াকড়ি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভুয়া সিম কার্ড ক্রয় বিক্রয় হচ্ছে টা কিভাবে? এ ব্যাপারে বলা যায় সিম কার্ড কেনার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের অসর্তকতা। যারা এই সিম কার্ড বিক্রি করেন তাদের মধ্যে এমন কিছু বিক্রেতা রয়েছেন যারা এ কাজটাতে জড়িত। কিভাবে?
নিয়ম অনুযায়ী এখন কেউ সিম কার্ড কিনতে গেলে তা যেকোন একটা পরিচয় পত্রের সাথে ব্যক্তির ছবি এবং আঙুলের ছাপ নেয়া হয়ে থাকে। আঙ্গুলের ছাপের জন্য যে বায়োমেট্রিক যন্ত্রে আঙ্গুল টা ছোঁয়ানো হয় সেখানেই ভুয়া সিম কার্ড এর আসল রহস্য টা লুকিয়ে থাকে। সিম কার্ড পেতে যেখানে বায়োমেট্রিক যন্ত্রে আঙ্গুল টা পরিস্কার করে আলতো চাপে স্পর্শ করলেই চলে সেখানে লক্ষ্য করলেই দেখা যায় বিভিন্ন উপায়ে বারকয়েক আঙ্গুল টা স্পর্শ করতে বলছেন সিমকার্ড বিক্রেতা। তার আঙুলের স্পর্শে যে ছাপগুলো তৈরি হয় সেটা দিয়ে পরিচয় পত্রের নথি পাল্টিয়ে তৈরি করা হয় ভুয়া সিম। এবং ওই সিম গুলো পরবর্তী সময়ে এক-দুই হাত করে এক স্হান থেকে অন্য স্থানে বিক্রি হযে পৌঁছে যায় সাইবার অপরাধীদের কাছে।
অন্যদিকে সরকারী বেসরকারী বিভিন্ন নামীদামী প্রতিষ্ঠানের নামে ও বহুজনের কাছে নানা ধরনের সুবিধাজনক প্রকল্পের নামে কিংবা বিভিন্ন প্যাকেজের নামে বা বিভিন্ন তথ্য জানার জন্য নানা ধরনের ওয়েব লিঙ্ক পাঠানো হয়।
অতি সম্প্রতি অমুক জায়গায় তমুক নামের ক্রাইম ব্রাঞ্চ থেকে ইমেইলে মেসেজ পাঠানো হচ্ছে যে, শিশু যৌন নিগ্রহ বা ওই ধরনের পর্ণোগ্রাফি ছবি নেটে আপলোড বা ডাউনলোড করার জন্য আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে জবাবদিহি করার। পুলিশের সাইবার সেলে বহুজন অভিযোগ করেছেন এবং করছেনও। সাইবার সেল থেকে অনেক সময় বলা হয় ওই সিম গুলোর সুনির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা পাওয়া যাচ্ছে না। এটা সাইবার অপরাধীদের কাজ। এ জাতীয় মেসেজ এড়িয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে সাইবার সেল। যদি কেউ এসব মেসেজের জবাব দিতে যায় তাহলে হ্যাক হয়ে যেতে পারে ফোন বা ল্যাপটপ। বলে রাখা ভালো, পুলিশের সাইবার সেল বা ক্রাইম ব্রাঞ্চের তরফে এভাবে কারোর বরাবর মেসেজ পাঠানো হয় না। অফিসিয়ালভাবে নির্দিষ্ট চিঠি অভিযুক্তদের বরাবরে পাঠানো হয়। মেসেজ করে লিঙ্কে যোগাযোগ করার নির্দেশ দেয়না।
প্রসঙ্গত, এই ওয়েব লিঙ্ক গুলো যারা পরিচালনা করছে অর্থাথ মুলচক্রী যারা তাদের হদিস পেতে হিমসিম খেতে হচ্ছে তদন্তকারীদেরও। মুলচক্রিরা বরাবরই ভুয়া সিম কার্ড দিয়ে ভুয়া তথ্য দিয়ে লিঙ্ক বানিয়ে তা ছড়িয়ে দিচ্ছে সমাজমাধ্যমে। বিশেষত এদের টার্গেট থাকে সেই অংশের অঞ্চলগুলো যেখানে বেকারত্বের হার বেশি, রাজনৈতিক বা সামাজিক কোনো না কোনো ঘটনার চর্চা বেশি। লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, কোথাও কোন একটা ঘটনা ঘটার সাথে সাথেই সমাজ মাধ্যম গুলোতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে অমুক ঘটনার দ্রুত আপডেট পেতে তমুক লিঙ্কে ক্লিক করুন কিংবা বেকার বিক্ষোভের কোন এক ঘটনার পর ছড়িয়ে পড়ে অমুক বোর্ডের তমুক কাজের সুযোগ পেতে সরাসরি খোঁজ নিন তমুক লিঙ্কে ইত্যাদি নানান সংক্রান্ত বার্তা। কিন্তু এসকলের বিশ্বস্হতা কই? এক্ষেত্রে অসতর্কতা ঘটিয়ে দিতে পারে বিপদ। কথায় আছে, বিকৃত করে মুখ চুলকাতে বড় সুখ আর ওই সুখটা সাধারণ মানুষ কে চুলকিয়ে উপভোগ করে সাইবার অপরাধীরা। এই অপরাধীরা শিকার করার আগে শিকারের মনস্তাত্ত্বিক ব্যআপারটা বিভিন্ন উপায়ে যাচাই করে। তাই সতর্ক থাকুন। সাবধানে থাকুন।
শিবব্রত চক্রবর্ত্তী