॥ সেলিনা শিউলী ॥ ‘ঢাকা যাচ্ছি, শিগগিরই আমি নিজেকে গুছিয়ে নেবো; তুমি টেনশন নিও না।’ মাকে এ কথা বলেই ঢাকায় ফিরেছিল তাহির জামান প্রিয়। ‘এবার যখন রংপুরে এলো, দিন পনেরো ছিল আমাদের সঙ্গে। দীর্ঘদিন পর ওর মেয়েকে দেখতে পেয়ে খুব খুশি হয়েছিল। মেয়েটাকে অনেক সময় দিয়েছে। বললাম বাবা, এবার থেকে কিছুদিন বাড়িতে মাসিক সংসারের খরচ দিও না। আমরা যেভাবে চলার চলছি। ভাল একটা চাকুরীর সন্ধান করো। তুমি নিজেকে একটু গুছিয়ে নাও। আটাশ বছর বয়সেও ছেলেটা আর শান্তি পেলো না।’
কথাগুলো বলছিলেন, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে শহিদ সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়’র মা সামসি আরা জামান।
প্রিয়’র সঙ্গে মা সামসি আরা জামানের শেষ কথা হয়েছিল বিদায় বেলায়। তিনি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, ‘ছোট থেকে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত ছেলেটা টেনশনই করে গেছে। ব্যক্তিগত বিষয় ও চাকরি-এই দুই নিয়ে ওর অনেক ঝামেলা ছিল। সব মিলিয়ে স্ট্রেস ছিল অনেক। সর্বোপরি মেয়েটাকে নিয়ে ভাবতো। সবকিছু মিলিয়ে এবার ঢাকায় গিয়েছিল নিজেকে গোছাতে। ওর আটাশ বছর বয়সে ছেলেটা আর সুখ পেলো না।’
অনলাইন পোর্টাল দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের ভিডিও জার্নালিষ্ট ছিলেন তাহির জামান প্রিয়। সরকারী চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে কর্মরত অবস্থায় ১৯ জুলাই ধানমন্ডীর সেন্ট্রাল রোডে ল্যাব এইড হাসপাতালের পিছনে বিকেল ৫ টায় পুলিশ ও ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশের গুলিতে প্রিয় শহিদ হন। দেশজুড়ে তখন কারফিউ চলছে। এর মধ্যে আন্দোলনে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রিয় শহিদ হন।
প্রিয়’র মা সামসি আরা জামান বলেন,২০ জুলাই হাসপাতালের সব প্রক্রিয়া শেষে ওকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ২১ জুলাই দাফন সম্পন্ন হয়। কিভাবে ওকে মেরেছে, কিভাবে ওর কাজে ব্যবহৃত ক্যামেরা,ক্যামেরার ব্যাগ, মোবাইল ও মানিব্যাগ পুলিশ নিয়ে গেছে, কোন গাড়িতে তুলেছে, সে সব ঘটনার অনেক ফুটেজ পেয়েছি। তাহির খুব সক্রিয় ছিল তার ক্যামেরায় ছবি তোলা আর ভিডিও করা নিয়ে। এসময় তার সঙ্গে ওর পরিচিত বন্ধুবান্ধব ও বড় ভাই কয়েকজন সেখানে আন্দোলন করছিল। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ পুলিশের গুলি তার মাথার পিছনে লাগে এবং ঘটনাস্থলেই তৎক্ষণাৎ সে মারা যায়। পাশেই অবস্থিত ল্যাব এইড হাসপাতালে তাকে কেউ নিতে পারেনি।
প্রিয়’র মা বলেন,আমার ছেলের নিথর দেহ ওখানেই পড়ে থাকে। অনেক পরে পুলিশ কিছুটা সরে গেলে সেই জায়গায় তার পরিচিতরা গিয়ে দেখে প্রিয়’র লাশ ওখানে নেই। ওকে কেউ খুঁজে পাচ্ছিল না। রাত দশটার দিকে আমরা জানতে পারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ওর লাশ পড়ে রয়েছে।
সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক শিক্ষার্থী তানভীর আরাফাত ধ্রুব ঘটনার স্মৃতিচারণ করে জানান, শহিদ সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়কে আমি চিনতাম না। কিন্তু এ ঘটনা আমার সামনেই ঘটেছে। সেদিন বিকেলে ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে প্রাণঘাতি বুলেট ছুঁড়তে থাকে পুলিশ। ছাত্র-জনতা কিছু বুঝে উঠার আগেই পুলিশের ৩০ থেকে ৪০ জনের একটি দল দ্রুত পিছন দিক থেকে গ্রীনরোডের মুখে চলে আসে। এসময় শুনি তাহির জামান এক মেয়েকে (সৈয়দা ফারিয়া উলফাৎ) বলছিল, ‘যাই হোক আমরা কিন্তু একসাথে থাকবো।’ সবাই পুলিশ বাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়ে যান এবং আন্দোলনকারীদের অনেকে হঠাৎ প্রচন্ড গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পান। তখন আমি সেন্ট্রাল রোড ও গ্রীন রোডের সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এসময় দেখি পুলিশ এবং অন্যান্য বাহিনীর ধাওয়া খেয়ে আন্দোলনরত ২৫-৩০ জন ছাত্র সায়েন্সল্যাবের দিক থেকে ধানমন্ডী আইডিয়াল কলেজমুখী সেন্ট্রাল রোডের ভিতরে ঢুকে অবস্থান নেয়। তিনি বলেন,পুলিশের একটি দল সায়েন্স ল্যাবের দিক থেকে এবং অপর একটি পুলিশের দল ল্যাব এইডের দুই ভবনের মাঝের রাস্তা ধরে ওয়াই শেইপে সেন্ট্রাল রোডের অভিমুখে একসাথে এগিয়ে যেতে থাকেন। পরক্ষণে দেখা যায় পুলিশের পোশাক পরিহিত ব্যক্তিরা মুর্হু মুর্হু গুলি ছুঁড়তে থাকে। আনুমানিক বিকেল ৫ টা ৫ মিনিটের দিকে আমি গুলির শব্দ শুনতে পাই। আত্মরক্ষার জন্য আমি ধানমন্ডী আইডিয়াল কলেজের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় ১০-১২ ফুট দূরে কমলা রংয়ের শার্ট ও কালচে রংয়ের প্যান্ট পরিহিত একজনের (তাহির জামান) এর নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখি। তার মাথার পিছন থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসতে দেখি। এসময় অজ্ঞাতনামা ৪-৬ জন আন্দোলনকারীদের একজন একটি সাদা টিশার্ট উঁচিয়ে তাহির জামান প্রিয়’র দেহ টেনে সেন্ট্রাল রোডে আনার চেষ্টা করে। গুলিবিদ্ধ দেহটি ল্যাবএইড হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তখন পুলিশরা অনবরত গুলি ছুঁড়তে থাকে। আন্দোলনরত ছাত্ররা তাহিরের দেহ ল্যাব এইড হাসপাতালে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়। এসময় উপস্থিত সেই আন্দোলনকারীরা সবাই দৌঁড়ে প্রাণভয়ে সেন্ট্রাল রোডের দিকে ফিরে আসতে বাধ্য হয়।
জি এম ইফতেখার ওর একজন সুহৃদ ও স্কাউটিংয়ের বড়ভাই ৩১ জুলাই তার ফেসবুকের দেয়ালে তাহির জামান প্রিয়কে নিয়ে লিখেন, ছোট থেকে প্রিয় দেশকে ভালোবাসতো, সে স্কাউটিং করতো। ক্যাম্পের খবর পেলেই ব্যাগ গুছিয়ে আমার বাসায় চলে আসতো। স্কুলে পড়ার সময় ওর মা কলি আন্টি (সামসি আরা জামান) আমাকে বলতেন,‘বাবা,তুমি আমার বড় ছেলে প্রিয়কে দেখে রেখো।’
ইফতেখার আরেক জায়গায় লিখেলেন, ‘প্রিয় ছেলেবেলা থেকে শান্ত আর চুপচাপ ছিলো। বইয়ের মাঝে ডুবে থাকতো। চিন্তা-চেতনায় সবসময় বয়সের চেয়ে বেশি ভারিক্কি ছিল। সবসময় দেশ নিয়ে, বিশ্ব নিয়ে এবং মানুষের অধিকার ও দাবী আদায় নিয়ে কথা বলতো।’
তিনি বলেন, দেশ নিয়ে ও দেশের মানুষকে নিয়ে ভাবতো খুব। বলতাম, মধ্যবিত্ত পরিবার আমাদের,স্বপ্ন থাকবে,কিন্তু অনেক কিছু চাইতে নেই। সব আবদার পূরণ করতে গেলে প্রয়োজন হয় অনেক টাকার। আমরা চেয়েছিলাম ও মাস্টার্স শেষ করে একটা চাকরি করে পরিবারের হাল ধরবে। কিন্তু ও নিজের সিদ্ধান্তে পরিবারের সবার বিরুদ্ধে গিয়ে ঢাকায় প্রিয় পাঠশালা-সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউট থেকে প্রফেশনাল ফটোগ্রাফি (পেশাদার আলোকচিত্রি) কোর্সের ওপর ডিপ্লোমা করছিলো।
সামসি আরা জামান আরো বলেন, প্রিয় তার পেশার বিষয়ে ছিল আপোষহীন। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক সময় আহত হয়েছে। তার ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়েছে হামলাকারী ও পুলিশ। সে সুস্থ হয়েই আবার ফিরে গেছে পেশায়। এবার প্রিয় জানালো, চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে, ওর মেয়েটা কেবল স্কুলে ভর্তি হয়েছে। বললাম,আমাকে না বলে কেন চাকরিটা ছাড়লে? তোমার বাচ্চাটা আমার কাছে আছে তোমার তো এখন ইনকাম করা প্রয়োজন। শুনে বলল,‘আমি ফেডআপ। আমি এ চাকরি করবো না। এই চাকরিটা করে আমি আমার সন্তানকে খাওয়াতে পারছি না। আম্মু আমি মিথ্যে কথা বলে চলতে পারব না। মিথ্যা বলে মানুষকে আমি ভালো বানাতে পারবো না।’ কথা দিয়েছিল, ঢাকা ফিরে গিয়েই কোন একটা প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে জয়েন করবে।
সামসি আরা জামান বলেন, ১০ জুলাই ঢাকা গেল। একটা এনজিওতে, ‘গুটিপা’ নামে চামড়াজাত পণ্য তৈরির একটি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানে এবং বেসরকারি একটি টেলিভিশন চ্যানেল ‘এখন’ এ ইন্টারভিউ দেওয়ার কথা ছিল। প্রাণশক্তিতে ভরপুর আমার স্বপ্নবাজ প্রিয় এমন করে চিরতরে চলে যাবে তাতো ভাবিনি। কোন কিছুই ও সিরিয়াসলি নিত না; কোন সংকট হলেই সব সময় বলতো ‘কোন ব্যাপার না।’ সে স্বপ্ন দেখতে খুবই ভালোবাসতো। কত কথা মনে পরে, ছেলেবেলায় বলতো,‘আম্মু আমি বড় হলে অনেক বই কিনবো; বই কিনে আমার ঘরের সিলিং পর্যন্ত ভরিয়ে ফেলবো।’ আমি বলেছিলাম ঠিক আছে বাবা’ তুমি বড় হও আমি তোমাকে বই কিনে একটা ঘর ভরিয়ে দেবো।’ আমি ওকে নিয়ে অনেকে স্ট্রাগল করে বড় করেছি আমাকে সবসময় বলতো ‘আমার কষ্ট ভুলিয়ে দিবে, আমাকে ভালো রাখবে প্রিয়।’ দেশের বাইরে গিয়ে পড়তে চেয়েছিলো। পছন্দের জায়গা ছিল সুইজারল্যান্ডস। বলেছিল,‘দেখো আম্মু আমি যদি আইইএলটিএস করার সুযোগ পাই তাহলে ভালো স্কোর তুলতে পারবো; আমার এ বিষয়ে দক্ষতা রয়েছে। দেশের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করবো। তারপর আমার মেয়ে আর তোমাকে নিয়ে চলে যাবো।’
প্রিয় তার মেয়েকে খুব ভালোবাসতো। ফেসবুক পেজে মেয়েকে নিয়ে চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি পোস্টে প্রিয় লিখেছে,‘আমার মেয়ে পদ্মপ্রিয় পারমিতা। ৪ বছরে পা দিয়েছে পাখিটা। কাল থেকে ওর জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু। প্রথম স্কুল পদ্মর। ওর বাবা ও মা একই সাথে আমিই। সিংগেল ফাদার,আবার মায়ের দায়িত্বও আছে। আমার অতীত যা ছিল সেটা সুখকর নয়। কিন্তু অনাগত ভবিষ্যৎ আমাদের জন্য অনেক অনেক সুখকর হবে ইনশাল্লাহ।’
প্রিয়’র সহকর্মীর মাহাবুব আলম শ্রাবণ স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন,‘দুর্দান্ত ক্যামেরা চালাতে পারতো। ছবি আঁকতে ভালোবাসতো ছেলেটা। আড্ডাবাজ মানুষ ছিল প্রিয়। আর সবচেয়ে বড় যে বিষয় সে একটা স্বপ্নবাজ মানুষ। নিজ দেশ নিয়ে সিনেমা বানানোর খুব ইচ্ছে ছিলো ওর। আমাকে প্রায়ই বলতো শ্রাবণ আমার মুভিটা খুব সুন্দর হবে দেখিস। তুই কিন্তু থাকবি। কোন কাজের আগেই প্ল্যানিং করতো। ফুল খুব পছন্দ করতো, একটা মজার বিষয় ছিলো ও খুব ঘুম পাগল মানুষ ছিলো। কখনও চলতি পথে রাস্তায় একটা ময়লা পরে থাকলে নিজ হাতে উঠিয়ে ডাস্টবিনে ফেলতো। প্রিয় দিলখোলা আর আমুদে স্বপ্নবাজ মানুষ ছিলেন।’