মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে যেতে প্রতিজন কর্মী অন্তত পাঁচ লাখ টাকা করে দিয়েছিলেন রিত্রুদ্ধটিং এজেন্সিকে। এই পরিমাণ টাকা দেওয়ার পরও ১৭ হাজার কর্মী মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি। এসব কর্মীর ক্ষতিপূরণের অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৫০ কোটি টাকা। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হয়েছে তিন মাস।
কিন্তু এখনো ক্ষতিপূরণের অর্থ ফেরত পাননি কর্মীরা। রিত্রুদ্ধটিং এজেন্সিগুলোর দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেও কোনো লাভ হচ্ছে না। উল্টো মালয়েশিয়ায় যেতে অনেক কর্মী যে ঋণ নিয়েছিলেন, তা পরিশোধ করতে না পারায় অনেককে এখন পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। আর কর্মীদের ক্ষতিপূরণ পরিশোধের দায় এড়াচ্ছে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রা।
তারা বলছে, যারা মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে এই অর্থ নিয়েছে তাদের ক্ষতিপূরণের দায় নিতে হবে। বায়রা এই দায় নেবে না। গত ৩১ মে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কয়েক হাজার কর্মী মালয়েশিয়ায় যেতে না পারায় এ নিয়ে নানা জটিলতা তৈরি হয়। এ নিয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থাণ মন্ত্রণালয় দিচ্ছে এক হিসাব, আবার বায়রা দিচ্ছে আরেক হিসাব।
এই হিসাব চূড়ান্তকরণে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে মন্ত্রণালয়। কমিটি গত ২৩ জুন তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে, ১৭ হাজার কর্মী মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি। এই কর্মীদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিতে গত ১ জুলাই বায়রার সঙ্গে বৈঠক করেন সাবেক প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী। বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের জানান, ১৮ জুলাইয়ের মধ্যে কর্মীদের অর্থ ফেরত দেবে বায়রা।
যদি ১৮ জুলাইয়ের মধ্যে অর্থ ফেরত দেওয়া না হয়, তবে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এরপর গত ১৩ জুলাই মন্ত্রী জানান, ৭০ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করেছে বায়রা। কিন্তু সেই অর্থের পরিমাণ কত এবং কতসংখ্যক কর্মী অর্থ ফেরত পেয়েছেন নিশ্চিত করে তা জানাতে পারেননি। এর মধ্যেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেয়। এতে সব মন্ত্রণালয়ের মতো প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কাজও বন্ধ হয়ে যায়।
মালয়েশিয়ার এই ইস্যুও ধামাচাপা পড়ে। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট শপথ গ্রহণ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল গত ২৮ আগস্ট মালয়েশিয়ার অনুমোদিত রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক ও বায়রা নেতাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেন। তবে বৈঠকের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ওই দিনকার বৈঠকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে। যে কর্মীরা মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি, তাঁদের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দেওয়া কর্মীদের সবার টাকা দ্রুত সময়ের মধ্যে ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর কর্মীরা যে রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে পাসপোর্ট ও টাকা জমা দিয়েছেন, সেই প্রতিষ্ঠানকেই অর্থ ফেরত দিতে হবে।
সূত্র মতে, ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সাব-এজেন্সিসহ সব দালাল কর্মীদের ক্ষতিপূরণের অর্থ মূল ১০১টি রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে পৌঁছে দেবে। আর ৪ থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই ১০১টি রিক্রুটিং এজেন্সি ক্ষতিপূরণের ৮৫০ কোটি টাকা কর্মীদের বুঝিয়ে দেবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এটি বাস্তবায়িত হয়নি। উল্টো বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে বায়রা।
এ বিষয়ে বায়রার সাবেক জেনারেল সেক্রেটারি মোহাম্মদ আলী হায়দার বলেন, ‘মালয়েশিয়ার বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। কী পরিমাণ অর্থ এখন পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে বা কতজনকে দেওয়া হয়েছে তার কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। এগুলো যারা কর্মী পাঠিয়েছে তারাই বলতে পারবে। আমরা শুধু মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পালন করছি।’
পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কর্মীরা
মালয়েশিয়ায় যেতে রিক্রুটিং এজেন্সি দ্য সুপার ইন্টারন্যাশনালকে পাঁচ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন রাজবাড়ী জেলার বারোখালী উপজেলার বাসিন্দা রাজু আহমেদ। কিন্তু তাঁর মালয়েশিয়া যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। ক্ষতিপূরণের অর্থ ফেরত না পেয়ে উল্টো এখন তাঁকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। রাজু আহমেদ বলেন, ‘গত ১০ মে আমাদের এজেন্সি বলেছে, তারা আমাদের গ্রুপের কারো টাকা পায়নি।
এদিকে বিএমইটির ক্লিয়ারেন্স ছাড়াই ১৫ মে টিকিট কনফার্ম করে রিক্রুটিং এজেন্সি। কিন্তু বিএমইটির ক্লিয়ারেন্স না হওয়ায় ওই টিকিট বাতিল হয়। এরপর ২৬ তারিখ বিএমইটি ক্লিয়ারেন্স করা হয়। শেষ সময়ে এসে বিএমইটির ক্লিয়ারেন্স হওয়ায় আর টিকিট কনফার্ম করা যায়নি। ফলে আমি আর মালয়েশিয়ায় যেতে পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় তো যেতে পারিইনি, টাকাও ফেরত পাইনি। অর্থ ফেরত চাইলে শুধু সময় দেয়, কিন্তু অর্থ দেয় না। মালয়েশিয়ায় যেতে না পেরে আমরা কয়েকজন মিলে অভিযোগ জানিয়েছিলাম। কিন্তু অভিযোগের কোনো উত্তর এখনো পাইনি। আবার মূল এজেন্সির কাছে গেলে তারা বলে, আপনাদের অর্থ দেবে সাব-এজেন্ট। আপনারা সাব-এজেন্টের কাছে যান। তাদের চাপ দেন, অর্থ ফেরত পাবেন।’
রাজুর মতো আরো কয়েক হাজার কর্মী একইভাবে এমন পরিস্থিতিতে দিন পার করছেন। কর্মীরা বলছেন, ধারের টাকা জোগাড় করতে না পারলে তাঁদের আর বাড়ি ফেরা হবে না।
পটুয়াখালী সদর উপজেলার বাসিন্দা মো. রাব্বি হোসেন মালয়েশিয়া যেতে এলাকার নোমান নামের এক দালালকে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। রাব্বির মতো একই এলাকার মো. মাসুদ বয়াতি, ইকবাল ও আসাদুল্লাহ একই পরিমাণ অর্থ দিয়েছিলেন নোমানকে। কিন্তু তাঁরা কেউ মালয়েশিয়া যেতে পারেননি। এখন অর্থ ফেরত না পেয়ে তাঁদের পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
রাব্বি হোসেন বলেন, ‘বর্তমানে আমরা ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্যে আছি। সুদে টাকা ধার নিয়েছিলাম। বাড়ি গেলে সুদের টাকা দিতে হবে। কিন্তু কিভাবে দেব সুদের টাকা? ফলে বর্তমানে আমাদের পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে।’
আরেক কর্মী মাসুদ বয়াতি বলেন, ‘আমরা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেছি। তারা শুধু অপেক্ষা করতে বলে।’
তবে মালয়েশিয়ার সঙ্গে ফের আলোচনার কথা জানিয়েছেন অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা সংস্থা রামরুর পরিচালক মেরিনা সুলতানা। তিনি বলেন, ‘এখনো অনেকে মালয়েশিয়া যাওয়ার আশায় রয়েছে। যেহেতু টাকা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে, তাই অন্তর্বর্তী সরকারকে মালয়েশিয়ার সঙ্গে আবারও আলোচনার চেষ্টা করতে হবে।’
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ জালাল উদ্দিন শিকদার বলেন, ‘কর্মীদের গন্তব্য দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে মালয়েশিয়ায়। দুর্নীতির সঙ্গে যুক্তদের বিচারের আওতায় আনতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। কত টাকা এবং কারা এর সঙ্গে যুক্ত এসব তথ্য বের করতে হবে। তবে কোনো নথি না থাকায় টাকা আদায় করা সহজ হবে না। আইনের মারপ্যাঁচে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো যাতে বের হয়ে যেতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’