নতুন বছরের বাকি মাত্র ৪৫ দিন। এখনো ছাপার বাকি প্রায় ৩৫ কোটি বই। প্রাথমিকের বই ছাপা শুরু হলেও মাধ্যমিক ও মাদরাসার বইয়ের কাজ শুরু হয়নি। মাঝে আছে মাত্র একটি মাস।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে এত বই ছাপা সম্ভব নয়। এমনকি অর্ধেক বই ছাপাও খুব কঠিন। এমন পরিস্থিতিতে আগামী বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীরা অর্ধেক বইও পাবে না বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) শিক্ষার্থীদের হাতে যথাসময়ে নতুন বই দেওয়ার প্রত্যাশার কথা জানিয়েছে।
এনসিটিবি সূত্র জানায়, আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য ৪০ কোটি ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০২টি পাঠ্য বই ছাপার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিকের বই ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫৫টি। বাকি প্রায় ৩০ কোটির বেশি বই মাধ্যমিক, মাদরাসা ও কারিগরি স্কুলের।
এনসিটিবি সূত্র জানায়, প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বই ছাপার কাজ চলছে।
কার্যাদেশ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে চতুর্থ থেকে অষ্টম শ্রেণির। তবে এ সপ্তাহেই ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির বইয়ের কার্যাদেশ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। গত বুধবার দশম শ্রেণির বইয়ের দরপত্র আহ্বান করা হয়। নবম শ্রেণির দরপত্র এ সপ্তাহেই আহ্বানের চেষ্টা চলছে। তবে মাধ্যমিকের কয়েকটি শ্রেণির কার্যাদেশ দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হলেও এখনো ইন্সপেকশন এজেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
সূত্র জানায়, অন্যান্য বছর বই ছাপার জন্য কার্যাদেশ শেষে এনসিটিবি ও প্রেস মালিকদের চুক্তির পর ৭০ থেকে ৯০ দিন পর্যন্ত সময় দেওয়া হতো। এ বছর সেই সময় দেওয়া হচ্ছে মাত্র ৪৫ দিন। কিন্তু প্রেস মালিকরা মৌখিকভাবে জানিয়েছেন, কোনোভাবেই ৪৫ দিনে সব বইয়ের কাজ শেষ করা সম্ভব নয়। যেসব বইয়ের দরপত্র প্রক্রিয়া চলছে, এগুলোর কার্যাদেশ দেওয়া শেষে চুক্তি করতেও ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগবে। এতে এ বছর প্রেস মালিকরা ৪৫ দিনও সময় পাবেন না।
বাংলাদেশ পাঠ্যপুস্তক মুদ্রক ও বিপণন সমিতির সভাপতি তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘বছরের শুরুতে কোনোভাবেই পুরো বই ছাপার সুযোগ নেই। অথচ এনসিটিবি এখন বলছে, তারা পুরো কাজ শেষ করবে। আমার মনে হয়, ডিসেম্বরের মধ্যে মাধ্যমিক ও মাদরাসার তিন থেকে পাঁচটি বই দেওয়া সম্ভব। তাই কোন বইগুলো আগে ছাপা হবে, তা যদি এনসিটিবি থেকে ঠিক করে দিত, তাহলে স্কুলগুলো পরিকল্পনা করতে পারত। এখন যেভাবে এগোনো হচ্ছে, এতে বই নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা তৈরি হবে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিবছর সাধারণত জুলাই-আগস্ট থেকে পাঠ্য বই ছাপার কাজ শুরু হয়। এর পরও ডিসেম্বরের মধ্যে শতভাগ বই দেওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু এ বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এনসিটিবিতে অনেক পরিবর্তন আসে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান, সদস্য ও অন্য কর্মকর্তারা বদলি হন। এরপর আবার নতুন শিক্ষাক্রম বদল করে আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়া হয়। পাঠ্যক্রমেও বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। এ বছর পাঠ্য বইয়ের কাজ দেরিতে শুরু হয়েছে। এরপর আবার পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত করতে অনেক সময় চলে গেছে। ফলে যথাসময়ে বই ছাপা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
প্রেস মালিকরা বলেছেন, গত বছর কার্যাদেশ শেষে মুদ্রাকরদের সঙ্গে এনসিটিবির চুক্তি সম্পাদনের পর কমপক্ষে বই ছাপতে ৭২ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। আর জুলাই থেকে পর্যায়ক্রমে দরপত্র শুরু হতো। ফলে একটি কাজ শেষ করে মুদ্রাকররা আরেকটি কাজ ধরতে পারতেন। কিন্তু এবার সব কাজ একসঙ্গে দেওয়া হচ্ছে। আর সময় কমিয়ে মাত্র ৪৫ দিন করা হচ্ছে। ফলে ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।
এনসিটিবি সূত্র জানায়, গত সপ্তাহে এনসিটিবি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে পাঠ্য বইয়ের পরিবর্তিত বিষয়গুলো নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে।
পরিবর্তিত বিষয়গুলোর মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণির বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সেটি কাটছাঁট করে যুক্ত করা হচ্ছে জিয়াউর রহমানসহ অন্যদের ভূমিকাও। এ ছাড়া মেজর জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক এবং মওলানা ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমদ, জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীসহ যাঁর যা ভূমিকা, সেগুলো ইতিহাসের অংশে যুক্ত হচ্ছে।
জানা যায়, আগামী বছর শিক্ষার্থীর সংখ্যার খুব একটা পরিবর্তন না হলেও বইয়ের সংখ্যা বেড়েছে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত আগে বই ছিল ১৪টি করে। পুরনো শিক্ষাক্রমে ফেরত যাওয়ায় আগামী বছর এসব শ্রেণির ২২টি করে বই ছাপাতে হবে। কৃষি শিক্ষা, গার্হস্থ্য অর্থনীতি, শারীরিক শিক্ষাসহ বেশ কয়েকটি বই এবার নতুন করে যাবে।
আবার যেহেতু বিভাগ বিভাজন ফিরছে, সে কারণে দশম শ্রেণিতে নতুন বই দিতে হবে। ফলে নবম-দশম শ্রেণির জন্য ৩৩টির মতো বই ছাপাতে হবে। এতে সব মিলিয়ে আগামী শিক্ষাবর্ষে প্রায় ছয় কোটি বই বেড়েছে, যা ছাপতে স্বাভাবিকভাবেই বেশি সময় লাগবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা অনুযায়ী যেকোনো দরপত্রের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময় থাকে। সেই সময়সীমা কমিয়ে আনলেও নবম ও দশম শ্রেণির দরপত্র আহ্বান শেষে তা জমা হতে কমপক্ষে দুই সপ্তাহের সময় প্রয়োজন। এরপর কার্যাদেশ শেষে নিয়মানুযায়ী আরো ২৮ দিন সময় দেওয়ার কথা। কারণ যে মুদ্রাকর কাজ পাবেন তিনি পারফরম্যান্স গ্যারান্টি (পিজি), ব্যাংকঋণ, কাগজের সরবরাহ নিশ্চিত হওয়ার পরই এনসিটিবির সঙ্গে চুক্তি করবেন। এরপর আবার ৭২ দিনের কাজ ৪৫ দিনের মধ্যে করতে হবে। ফলে সব কিছু মিলিয়ে একটি বড় জটিলতায় পড়তে হবে।
সার্বিক বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, ‘প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বই এ মাসের মধ্যেই চলে যাবে। চতুর্থ থেকে পঞ্চম শ্রেণির সব বই ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে চলে যাবে। মাধ্যমিকের ৭০ শতাংশ বই আমরা ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে পৌঁছানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। ৯০ শতাংশ বই যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি ২৫ ডিসেম্বর। আমরা দিনরাত কাজ করছি। প্রেস মালিকরাও সর্বোচ্চটা দেবন বলে জানিয়েছেন। আশা করছি, আমরা যথাসময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছাতে পারব।’