ঢাকা
২২শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
সকাল ৯:২৪
logo
প্রকাশিত : অক্টোবর ৬, ২০২৪

মেহেদী হাসানের বুক ছিল অসংখ্য বুলেটে ঝাঁঝরা; বুঝিনি আর জেগে উঠবে না

॥ সেলিনা শিউলী ॥
‘মেহেদীর বুক ছিল অসংখ্য বুলেটে ঝাঁঝরা। ক্লান্তিতে ভরা চোখমুখ। মুখমণ্ডল দেখে মনে হয়েছে যেন দীর্ঘ ক্লান্তির পর প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন। আইসিইউয়ের বেডে চোখ বন্ধ করা মেহেদীকে দেখে বুঝিনি সে বেঁচে নেই, আর কোনদিন চোখ খুলবে না।’
কান্নাজড়িত কন্ঠে কথাগুলো বলছিলেন সাংবাদিক মেহেদী হাসানের স্ত্রী ফারহানা নীপা।
নীপা বলেন, দুপুরের দিকে মোবাইলে কল দিয়ে বলেছিলাম, ‘আজ সকাল থেকে আমার মনটা জানি কেমন করছে। তুমি চলে আসো।’ আমাকে ধমক দিয়ে মেহেদী বলেছিল, ‘আমি দায়িত্ব পালন করছি। এটা আমার পেশা।’
গত ১৮ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়িতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার সাথে পুলিশের সংঘর্ষ চলাকালে  ঢাকা টাইমস’র সিনিয়র রিপোর্টার মেহেদী হাসান(৩১) ওই এলাকায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলেন।  এ সময় পুলিশের ছোঁড়া গুলিতে তিনি শহিদ হন।
ওই সময়ের বর্ণনা দিয়ে দৈনিক বাংলাদেশের আলো’র স্টাফ রিপোর্টার ইমাম হোসেন ইমন বাসসকে বলেন, ‘অন্যান্য দিনের মতো সেদিন সকাল থেকেই পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলাম। আমাকে মেহেদী বেলা ১১ টায় ফোন দিয়ে জুরাইন যেতে বলে। দুপুর ১২ টার দিকে আবার কল দেয়। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে সেখানে যাই। আমরা মোটর সাইকেলে চড়ে যাত্রাবাড়ির দিকে রওনা দেই। প্রথমে যাত্রাবাড়ি থানার নিচে অবস্থান নিয়ে দেখতে পাই সেখানে পুলিশ ও বিজিবি অবস্থান নিয়েছে। কাজলার দিকে অবস্থান নিয়েছে ছাত্র-জনতা। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলছে। আমরা আরেকটু আগাই। টিয়ারসেল, সাউন্ড গ্রেনেড আর গ্যাসের ঝাঁঝে সেখানে আর থাকা যাচ্ছিল না, চোখ জ্বলছিল। আমরা ফ্লাইওভারের উপরের দিকে উঠি। হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজার কাছে তখন পুলিশ ও ছাত্র-জনতার মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলছিল। এর মধ্যে সুফিয়া প্লাজা (বড় একটা গার্মেন্টস) বরাবর ফ্লাইওভারে একজন ছাত্রকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখি। এই ছবি ও ভিডিও কালেকশন করি।’
তিনি বলেন, ফ্লাইওভারের নিচে কিছু সাংবাদিক ছিল, আমরা তাদের কাছে গুলিবিদ্ধ লাশটির কথা জানাই। সেখানে দুইটা ট্রাক রাখা ছিল নানা সরঞ্জামাদিতে ভরা। দুইজন ট্রাক ড্রাইভারকে একজন পুলিশ কর্মকর্তা টেনে হিচঁড়ে উপরের দিকে নিয়ে যায়। মেহেদী সম্ভবত ফ্লাইওভারের উপর থেকে ফুটেজ নিচ্ছিল। এতে পুলিশ কর্মকর্তা ক্ষিপ্ত হয়ে তার মোবাইলটা  নিয়ে যায়। পরে আমিসহ কয়েকজন সাংবাদিক মেহেদীর মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করি। কাজের ফাঁকে আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে নেই।
ইমাম জানায়, বিকেল ৫ টা ৪০ এর দিকে যাত্রাবাড়ীর মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজার উপরের অংশে পুলিশ তার এপিসি কার নিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দিকে দ্রুত এগিয়ে আসে। এপিসিটি এতো দ্রুত চালানো হচ্ছিল যে যা আগে কখনও দেখা যায়নি। মনে হচ্ছিল আন্দালনরত শিক্ষার্থীদের চাপা দেয়াই তাদের উদ্দেশ্য। এ সময়ে এপিসির বামপাশে প্রায় ৩০/৩৫ জনের মতো ছাত্র আটকা পড়েছিল। পুলিশ এপিসি নিয়ে যত দ্রুত সামনে গেছে তত দ্রুত ব্যাকে এসে বামদিকে আটকে থাকা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি করতে শুরু করে। এ সময়ে মেহেদীকেও সরাসরি গুলি করা হয়। মেহেদীর শরীরে কয়টা গুলি লেগেছে আমি জানি না। পরিস্থিতি এতোটাই ভয়ংকর ছিল যে আমি আইল্যান্ডের পাশে বসে পড়ি।
হঠাৎ দেখি মেহেদী ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে ঘাড়ে হাত দিয়ে বলেছিল, ‘ভাই...গু...লি .ক..র..ছে’, বলেই হেলে পড়ে যায়। এ দৃশ্য দেখে আমি যে তার কাছে যাবো সেই অবস্থায় ছিলাম না, অথচ মাত্র ১০ হাত দূরে মেহেদী পড়েছিল। গুলিবর্ষণ থামতেই আমি ফ্লাইওভারে থাকা পুলিশ সদস্যদের কাছে ছুটে যাই। তাদের কাছে সাহায্য চাই। সাংবাদিক মেহেদী গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে থাকার কথা জানালেও তারা কেউ এগিয়ে আসেননি।
যাত্রাবাড়ীর কাজলার বাসিন্দা এবং মুন্সিগঞ্জ পলিটেকনিকেল ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী ও  প্রত্যক্ষদর্শী ইয়াছিন আহমেদ নামের একজন শিক্ষার্থী বাসসকে জানান, ১৮ জুলাই আমরা আন্দোলনে ছিলাম। আমি ছিলাম মূলত কাজলার দিকে। পুলিশ টিয়ারশেল ও গুলি ছুঁড়ছিল। সেখানে একজনের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখি। সেই মরদেহ আনতে গিয়ে দেখি সামনে আরেকজন পড়ে আছে তার গলায় সাংবাদিকের পরিচয়পত্র ঝুলানো।
তিনি বলেন, হাসান মেহেদীর মোবাইল ফোনটি আনলক করা অবস্থায় ছিল। তিনি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর হয়তো পরিবারকে ফোন দিতে চেয়েছিলেন। আমি তার মোবাইলে ‘আপুু’ নামের যে নাম্বারটি দেখতে পাই সেই নম্বরে কল দেই। ওই নম্বরে ফোন করলে ওনার ওয়াইফের সঙ্গে আমার কথা হয়। জানলাম উনি কেরানীগঞ্জ থাকেন। তিনি বারবার মেহেদী ভাইকে হাসপাতালে নিতে বলেন। তাকে যাত্রাবাড়ীর স্থানীয় একটি ঔষধের দোকানে নিয়ে যাই। সেখানে উপস্থিত ডাক্তার তাকে দেখে জানান, তার বুক রাবার বুলেটে ভরা। তিনি তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পরামর্শ দিলেন। আমরা পাশের  অনাবিল (প্রাইভেট) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর
ওই হাসপাতালের চিকিৎসকরা উনাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। ইলেকট্রিক শক দিলে হয়তো ঠিক হতে পারে এই কথা বললেন তারা। আমরা তখন একটা এম্বুলেন্সের ৩-৪ জন আহত রোগীর সঙ্গে ওই সাংবাদিককে নিয়ে  ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক জানালেন তিনি আর নেই বেঁচে নেই, মারা গেছেন। এর মধ্যে উনার পরিবারের লোকজন চলে আসেন।
মেহেদী হাসানের সহধর্মিনী নীপা বলেন, ‘মেহেদী যে এই পৃথিবীতে নেই তা ভাবতে পারি না। সেদিন বিকেলে আমাকে কল দিয়েছিল। ছাদে কাপড় শুকাতে গিয়েছি শুনে বলেছিল, ‘তুমি রোদের মধ্যে ছাদে গেছো কেন? তোমার তো লো প্রেশার। জানালো, ঢাকার অবস্থা খুবই খারাপ। বাসায় এসে রাতে সব বলবো। এই ছিল তার সঙ্গে আমার শেষ কথা।’
তিনি বলেন, প্রতিদিন মেহেদী খাবারের পর কল দিয়ে জানাতো, এরপর আমি খেতে বসতাম। সেদিনও বিকেলে খাবার খেয়েছি, দুইমেয়েকে নিয়ে শুয়েছি, এমন সময় বাড়িওয়ালার মেয়ে এসে বলল, ‘দেখো কে যেন কল দিয়েছে। আমি শুনে ভাবছি জাস্ট গুলি লাগছে। আমি উনাকে বলি, আমি আপনার হাতে ধরি, পায়ে পরি, আল্লাহর দোহাই, আপনি ওকে কোন হাসপাতালে নিয়ে যান।’
পরে ওই ছাত্রটি মেহেদীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইর্মাজেন্সিতে নিয়ে যায়। আমি হাসপাতালে গিয়ে দেখি আইসিইউতে মেহেদী খালি গায়ে শুয়ে আছে। ভাবছি বেঁচে আছে, পরে শুনলাম সে আর নেই।

তিনি বলেন, সেদিন বড় মেয়ে তার বাবাকে বলছিল, আব্বু আসার সময় ফল নিয়ে আসবা। এখন আমি কি জবাব দিবো মেয়েকে। ঢাকায় এক শতাংশ জমি কিনে তাতে একটা কুঁড়ে ঘর বানানোর স্বপ্ন ছিল তার। এখন সন্তানদের নিয়ে অন্ধকার দেখছি কেবল।
পটুয়াখালীর বাউফলে জন্ম নেয়া মেহেদীর বাবার নাম মোশাররফ হোসেন। পরিবারের বড়ো  সন্তান ও একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তিনি।
মেহেদীর বাবা মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘স্ট্রোকের রোগী আমি, তিনটা ব্লক আমার হার্টে। মেহেদীর স্বপ্ন ছিল আমার হার্টের অপারেশন করাবে। ওকে হারিয়ে আমার বুকের পাঁজর ভেঙ্গে গেছে। সে ছিল সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম। সন্তানের লাশ বাবার কাঁধে অনেক ভারি। আজীবন আমাকে সেই ভার বয়ে বেড়াতে হবে।’
ঢাকা টাইমসের সিনিয়র রিপোর্টার মোরশেদুল জাহের মেহেদীকে নিয়ে করা এক প্রতিবেদনে বলেছেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় ১৮ জুলাই গুলিতে নিহত হাসান মেহেদী আগের দিন ‘শান্তির নাকি নতুন পরিস্থিতির অপেক্ষা’ এই টাইটেল ভিডিওতে সর্বশেষ কন্ঠ দেন।’
ফেসবুকে মেহেদী কোন একদিন লিখেছিলেন, ‘আমি একদিন খবরের শিরোনাম হবো।’ ঠিক তাই। শেষ পর্যন্ত মেহেদী দেশ ও বিদেশের সকল গণমাধ্যমেরই শিরোনাম হতে পেরেছিলেন। কিন্তু পারলেন না ছোট্ট একটি কুঁড়েঘরের স্বপ্ন পূরণ করে  পরিবারটিকে গুছিয়ে দিয়ে যেতে। তাই অসহায় পরিবারটি মেহেদীকে হারিয়ে কেবল হৃদয়ের থেকেই নয়, শূন্য হয়ে গেছে আর্থিকভাবেও।বাসস

সর্বশেষ
logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ তাপস রায় সরকার
মোবাইল: +৮৮০ ১৭৩৬ ৭৮৬৯১৫
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1736 786915, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2024 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram